ভালোবাসা
– রাখী চক্রবর্তী
টুপটুপ টুপটুপ, বৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে।
বর্ষাকাল এলেই আমার দেহ, মন, ভাবনা চিন্তা সব পাখনা মেলতে শুরু করে। তাই দুই বছর ধরে অশান্ত ভাঙাচোরা মনকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছি নীল গগনে।
আজও মনে পড়ে, গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে গিয়ে দুদণ্ড বসতে না বসতেই মহারাণী হাজির হতেন। বর্ষা রাণী গো বর্ষা রাণী। নীলু আমার হাতের ওপর হাত রেখে একটু ভাব ভালবাসার কথা বলছিল। সেই মূহুর্তে ঝমঝম করে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি ।আমার সারা শরীর ভিজে গেল। নীলু হ্যাংলার মতো আমার ভিজে শরীরের দিকে তাকিয়ে ছিল।নীলু আমাকে ছুঁতেই আমি ছুট লাগালাম। সেই দিন থেকে বৃষ্টি আমার কাছে নানান ছন্দে আসতে লাগলো। শিহরিত উচ্ছাসিত হয়ে যাই আমি, বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা গায়ে লাগলেই।
নীলু মামা বাড়িতে এসেছিল শান্তিপুরে।আমার মাসির বাড়িও শান্তিপুরে। একদম পাশাপাশি বাড়ি। আলাপ পরিচয় হলো, তারপর যা হয় আর কি! কিসের নেশায় শান্তিপুর ছুটতাম মা একদিন ধরে ফেললো।নীলুও চেন্নাই চলে গেল। বছরে দু’বার আসত ও কোলকাতায় আমার জন্য । মা বাপীও মেনে নিল আমাদের সম্পর্ক।
এমনি এক বর্ষার দিনে খুব ইচ্ছে করছিলো বাধাঘাটে নৌকা করে এপার ওপার করবো।নীলুর ইচ্ছে ছিল না তবুও রাজি হল আমার কথা ও ফেলতে পারে না তাই।
বাপীর একদম মত নেই। দুমাস আর বাকি আমাদের বিয়ের।
মা বললো, যাক না দুটিতে একটু আনন্দ করে আসুক।
কি বিশাল চওড়া গঙ্গা। কি সুন্দর ভুতনাথের মন্দির।
সারা জীবনের আনন্দ যেন আমি এইক্ষণেই পেয়ে গেলাম। ভুতনাথ মন্দিরে পুজো দিয়ে আমরা নৌকা করে গঙ্গার ওপারে চলে গেলাম। খুব আনন্দ করলাম।সন্ধ্যা বেলায় বাড়ি ফেরার তাড়া, মনটা উদাস হয়ে গেল। নীলু দুদিনের জন্য কলকাতাতে এসেছে। আবার চলে যাবে চেন্নাই। বিয়ের দু’দিন আগে আসবে কোলকাতায়। তখন একেবারে ছাদনাতলায় দেখা হবে আমাদের।
এর মধ্যে হঠাৎ নীলু মাথা ধরে ছটফট করতে লাগলো। আমি তো ভয়ে কাঁপতে শুরু করলাম। কোনোমতে নীলুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে হসপিটালে গেলাম। ডাক্তার বাবু বললেন, ব্লাড টেস্ট করতে হবে। হলোও ব্লাড টেস্ট। ব্লাড টেস্টের রিপোর্টে ক্যানসার ধরা পড়েছে লাস্ট স্টেজ। না, আর সময় দেয়নি নীলুর জীবন। সব শেষ হয়ে গেল। ঝমঝম করে তুমুল বৃষ্টি পড়ছিল যখন নীলুর ডেডবডি এল। সেই দিনকার মতো ভিজে কাপড় আমার সারা শরীর জুড়ে বিরাজ করছে কিন্তু নীলু আর হ্যাংলার মতো তাকিয়ে নেই আমার দিকে। চোখ দু’টো ওর বন্ধ যে।
সেই থেকে শুরু হলো আমার অদৃশ্য নীলুর সাথে পথ চলা, নীলুর সাথে কথা বলা।ডাইরির পৃষ্ঠা বন্ধ করে ডাইরিটা টেবিলের ওপর রেখে রুপু শুয়ে পড়লো।
বৃষ্টি হচ্ছে তুমুল, সানাইয়ের সুরের ঝংকারে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে এক পার্থিব সুখ অনুভব করছি আমি। মনে হচ্ছে যেন হাজার প্রজাপতি পাখনা মেলে আমাদের ভালবাসার আসিয়ানা সাজাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে নববধু সাজে দেখছি, নীলু ধুতির কোঊচা ধরে মিষ্টি হেসে মাথা নিচু করে চোখটা তুলে আমাকে দেখে আবার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। টোপর পড়ে কি সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। মালা বদল হবে এক্ষুণি।
যদিদং হৃদয়ং মমঃ তদিদং হৃদয়ং তব “
- রুপু কতো ঘুমাবি ওঠ মা।
– ও মা, কতো বেলা হয়ে গেল! ডাকো নি কেন? কত্ত কাজ বাকি। বিয়ের দিন এগিয়ে এলো। তোমরা না কি যেন একটা…বাপী কোথায় গেল?
– চল রুপু মুখ ধুয়ে নে। চা খেয়ে তারপর যাবি আমার সাথে ।
– না মা, বিয়ের আগে বাড়ির বাইরে আমি পা রাখবো না।
নীলু বারণ করে দিয়েছে। বেনারসি শাড়িটা বের করে রাখো মা। আমি স্নান সেরে আসছি। আজ আবার দেখবো বেনারসিটা।
মেয়ের চিন্তাতে শিবানী দেবী মন মরা হয়ে থাকেন সর্বদা। দিন দিন মাথা খারাপ, পাগলামো বেড়েই চলেছে মেয়ের। ভবিষ্যতে কি হবে মেয়ের? কে দেখবে ওকে?
রুপুর মা মাথায় হাত দিয়ে খাটের ওপর বসে বললো, শুনছো অবনী ফোন করেছিল আজ। আজ আবার রুপুকে নিয়ে ওর কাছে যেতে হবে।
কোলকাতার নাম করা সাইক্রাটিস্ট অবনী সেন রুপুর ট্রিটমেন্ট করছে । তাও এক বছর হতে চললো।
রুপুর মা বাপী ওকে নিয়ে আজ আবার অবনী ডাক্তারের চেম্বারে এল। নামকরা সাইক্রাটিস্ট- অবনী ঘোষাল।
রুপুর বাপী অবনী ডাক্তারকে বললো, বলো না ডাক্তার রুপু স্বাভাবিক জীবনে আসতে পারবে তো। এতো ভালো ঘরে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওদের তো সবকিছু বলিনি। সব শুনে যদি রুপুকে বিয়ে না করে সুজয়। বড় ভয় করছে ডাক্তার।
-ঠিক আছে তুমি বৌদি এখানে বসো। আমি রুপুকে চেকআপ করে আসছি।
অবনী ডাক্তার রুপুকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।
-কি গো মেয়ে আমার ভালো হয়ে যাবে তো?
-হ্যাঁ, ঠিক ভালো হবে। অবনী আমার বন্ধু বলে বলছি না ওর কিন্তু ডাক্তার হিসাবে সুনাম আছে। কোনও পেশেন্ট ঠিক হয়নি আজ অব্দি এমন কথা কিন্তু শোনা যায়নি।
অবনী ডাক্তার রুপুকে চেম্বারের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বললো, অনেক তো হলো মা, এবার তুই বিয়ে করে নে। নিজের মতো করে বাঁচ। মা বাবা আর কদ্দিন আছে। পাহাড় সমান জীবন কি করে কাটাবি মা?
-কেন ডাক্তার কাকু নীলু আছে তো আমার পথ চলার সাথী হয়ে। তুমি আমার জন্য যা করলে তা আমি চিরকাল মনে রাখব। মা বাপীর জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। আমি একমাত্র সন্তান হয়েও ওনাদের সুখ শান্তি দিতে পারলাম না। অনেক কষ্ট করে অভিনয় করি ডাক্তার কাকু। অন্য পুরুষের সঙ্গে না না,, কিছুতেই না, ডাক্তার কাকু আসি এবার।মা বাপীকে বলে দিও রুপু স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরবে না।
বাড়ি ফিরে রুপু ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে রইলো। রাত্রি আটটা বাজে, নীলু নীলু বলে দু’বার ডাকলো রুপু।একটা দমকা হাওয়াতে ঘরের জানালার পাল্লাগুলো নড়তে লাগলো।
-কি হচ্ছে রুপু?
-নীলু আজ এত দেরি করে এলে?
-আগে বলো আমার কথা শুনবে?
-হ্যাঁ নীলু, তোমার কথা আমি শুনবো না। এ আবার হয় নাকি।
-কথা দাও তুমি বিয়ে করবে, তোমার মা বাপী যেখানে বিয়ে ঠিক করেছেন। হ্যাঁ বলো, বলো হ্যাঁ,
-কিরে রুপু দরজা খোল মা। সুজয়ের বাবা আবার এখন ফোন করেছেন। এ মাসেই বিয়ের ভালো লগ্ন আছে। ওনারা তো এমাসেই শুভ কাজ করতে চাইছেন। কি বলবো বল মা। তুই রাজি তো মা। একবার হ্যাঁ বল মা..
– রুপু হ্যাঁ বলো, হ্যাঁ, কি হল বলো হ্যাঁ..
রুপু লাজুক সুরে বললো- হ্যাঁ..
রুপুর মা চিৎকার করে ওর বাপীকে বললো, রুপু হ্যাঁ বলেছে। তুমি বিয়ের তোড়জোড় শুরু করো। ভগবান এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছে।
রুপু নীলুর স্পর্শ অনুভব করছে, রুপুর সারা শরীর কেঁপে উঠছে। নীলু তোমার কাছে আমাকে নিয়ে চলো, আরও একবার হাতটা ধরো নীলু।
একটা দমকা হাওয়াতে জানলার পাল্লাগুলো বন্ধ হয়ে গেল।
রুপু বিছানার চাদর কামড়ে ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো।
পরদিন সকাল বেলায় সুজয়ের বাবা আত্মীয় স্বজন নিয়ে পাটিপত্র করতে এসেছেন।
রুপু শাড়ি পড়ে আয়নার সামনে বসে আছে। কপালে লাল টিপ, হাতে চুরি, গলায় চন্দ্রহার রুপুকে পড়িয়ে দিয়ে নীলু বললো, সুখী হও তুমি। যাও..
বিয়ের দিন রুপু দু’হাত শক্ত করে রেখে দিয়েছে। নীলু আলতো করে রুপুর হাত সুজয়ের হাতের ওপর রেখে দিয়ে বললো, আজ আমার আত্মা মুক্তি পেল। পুরোহিত মশাই মন্ত্র বলছে যদিদং হৃদয়ং মম তদিদং হৃদয়ং তব.. রুপু দেখলো নীলুর ছায়া আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
রুপুর চোখ বিয়ের মণ্ডপের সাজসজ্জা, ঝাড়বাতি, মখমলের পর্দা, নানান সুগন্ধী ফুলের তোড়া সব এর মধ্যে নীলুকে খুঁজছে আর নীলু নীল দিগন্তের শেষ প্রান্তে এসে দেখলো তার ভালবাসা নববধুর সাজসজ্জায় সেজে বসে আছে ভালোবাসার আঙিনায়।